যে সকল রহস্যের সন্ধান বিজ্ঞান এখনো পায়নি !
বর্তমান পৃথিবীতে বিজ্ঞান সৃষ্টিজগতের অনেক রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে, তবুও কিছু ধাঁধা রয়ে গেছে যা আজও বিজ্ঞানীদের চ্যালেঞ্জ করে। এসব বিষয় এখনও অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে আবৃত, তাদের জটিলতা এবং রহস্যময়তা আমাদেরকে রীতিমত বিস্মিত করে। পৃথিবী এমন একটি গ্রহ, যেখানে অনেক অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে, যেগুলো বিজ্ঞানের জন্য এখনো পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি। মহাসাগরের গভীরতা থেকে শুরু করে বায়ুমণ্ডলের বিস্তৃত পরিসর পর্যন্ত, অনেক ঘটনাই বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্ত করে এবং সেই সাথে অজানার প্রতি আমাদের কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়।
আজকের এই নিবন্ধে আপনি এমন তেরোটি রহস্য সম্পর্কে জানতে চলেছেন যেগুলোর প্রতিটি বিজ্ঞানীদের জন্য এখনও এক একটি ধাঁধা। বিশ্বের এই অজানা রহস্যগুলো উন্মোচনের জন্য গবেষকরা দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করলেও, এগুলো এখনো তাদের বিস্মিত ও বিভ্রান্ত করে রেখেছে।
১. চেতনা
চেতনা কী? সহজভাবে বলতে গেলে, এটি সেই শক্তি যা আমাদের চিন্তা, সচেতনতা এবং আত্ম-উপলব্ধি জাগিয়ে তোলে। কিন্তু এটি এখনো সবচেয়ে গভীর রহস্যগুলোর একটি রয়ে গেছে। স্নায়ুবিজ্ঞানে এত উন্নতি হওয়ার পরেও, কীভাবে স্নায়বিক সংকেত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়, সেই সঠিক প্রক্রিয়া এখনো মানুষের অজানা। ১৯৯৫ সালে দার্শনিক ডেভিড চ্যালমার্স ‘চেতনার কঠিন সমস্যা’ শব্দটি ব্যবহার করে এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন, কেন এবং কিভাবে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো ব্যক্তিগত সচেতনতার জন্ম দেয়?
২. ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাবিশ্বের প্রায় ৯৫% অংশ ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি দ্বারা গঠিত, যা আমাদের বর্তমান শনাক্তকরণ পদ্ধতিতে অদৃশ্য। দৃশ্যমান পদার্থের উপর মহাকর্ষীয় প্রভাবের মাধ্যমে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব প্রথম প্রমাণ করেন ফ্রিটজ জুইকি ১৯৩৩ সালে। মহাবিশ্বের দ্রুত সম্প্রসারণ ব্যাখ্যা করতে ডার্ক এনার্জির ধারণা প্রস্তাবিত হয়েছে, যা আরও রহস্যময়।
৩. প্লাসিবো এফেক্ট
প্লাসিবো ইফেক্ট হলো এমন একটি ঘটনা, যেখানে একজন ব্যক্তির শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে প্লাসিবো বা ‘ডামি’ চিকিৎসা নেওয়ার পর।
প্লাসিবো শব্দটি ল্যাটিন ভাষার, যার অর্থ ‘আমি সন্তুষ্ট করব’। এটি এমন একটি চিকিৎসাকে বোঝায়, যা দেখতে আসল মনে হয়, কিন্তু এতে কোনো আসল চিকিৎসাগত উপকারিতা থাকে না। প্লাসিবো হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে একটি চিনি ভর্তি ট্যাবলেট, পানি বা লবণাক্ত পানির ইনজেকশন, কিংবা এমনকি একটি ভুয়া সার্জারিও।
প্লাসিবো ইফেক্ট সাধারণত ঘটে যখন ব্যক্তির বিশ্বাস হয় যে চিকিৎসাটি তাকে উপকার করবে, এবং সে নিজেকে সুস্থ বোধ করার প্রত্যাশা করে। এ ক্ষেত্রে প্লাসিবোর প্রকৃত গুণাগুণের চেয়ে বিশ্বাসটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
‘ইম্পিউর প্লাসিবো’ হলো এমন ওষুধ, যা শরীরের উপর সক্রিয় প্রভাব ফেলে, কিন্তু যে সমস্যার জন্য চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে তার উপর কোনো প্রভাব ফেলে না।
১৮০০ শতাব্দী থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়ে আসছে, যা দেহের উপর মনের প্রভাবকে প্রদর্শন করে। তবে, বিশ্বাসের মাধ্যমে শারীরিক নিরাময় ঘটানোর যে জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো কাজ করে, সেগুলো পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা এখনো সম্ভব হয়নি।
৪. ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটার অসমতা
বিগ ব্যাংয়ের সময় সমান পরিমাণে ম্যাটার এবং অ্যান্টিম্যাটার তৈরি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বে ম্যাটারই প্রাধান্য পেয়েছে। এই অসমতা পদার্থবিদদের বিভ্রান্ত করে, কারণ যখন ম্যাটার এবং অ্যান্টিম্যাটার মিলিত হয়, তারা একে অপরকে ধ্বংস করে। ১৯৬৭ সালে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ আন্দ্রেই সাখারভ কিছু শর্ত প্রস্তাব করেন যা এই অসমতা সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু সঠিক প্রক্রিয়াটি এখনও অজানা।
৫. কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি নীতি হলো কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট, যেখানে দুটি কণা এমনভাবে সংযুক্ত হয় যে, তারা দূরত্ব নির্বিশেষে তাৎক্ষণিকভাবে একে অপরকে প্রভাবিত করে। আলবার্ট আইনস্টাইন এটিকে “দূর থেকে ভৌতিক প্রভাব” বলে অভিহিত করেছিলেন। যদিও এটি কোয়ান্টাম তত্ত্বের একটি মৌলিক দিক, তথাপি এর তথ্য স্থানান্তর এবং বাস্তবতার উপর প্রভাব পুরোপুরি বোঝা যায়নি।
৬. জীবনের উৎপত্তি
অজৈব রাসায়নিক পদার্থ থেকে জীবিত জীবের সৃষ্টি একটি গভীর রহস্য। ১৯২০-এর দশকে জেবি এস হালডেন এবং আলেকজান্ডার ওপারিন প্রস্তাবিত ‘প্রাথমিক স্যুপ’ তত্ত্বটি ইঙ্গিত দেয় যে, সরল জৈব যৌগগুলো থেকে জীবন তৈরি হয়েছে, তবে সঠিক ধাপগুলো এখনো অজানা।
৭. টার্বুলেন্স
তরল গতিবিদ্যা একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ক্ষেত্র হলেও, টার্বুলেন্স—তরলের বিশৃঙ্খল, অপ্রত্যাশিত গতিবিধি—সম্পূর্ণ গাণিতিক বর্ণনার বাইরে রয়ে গেছে। ১৫০০ শতাব্দীতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এর জটিল প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কিন্তু টার্বুলেন্সকে সব স্তরে ব্যাখ্যা করতে পারে এমন একটি সমন্বিত তত্ত্ব এখনও বিজ্ঞানীরা খুঁজে চলেছেন।
৮. সময়
সময় আমাদের বাস্তবতার একটি মৌলিক দিক, কিন্তু এর প্রকৃত স্বরূপ এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সময়কে একটি আপেক্ষিক ধারণা হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, সময়ের প্রবাহ এবং এর দিকনির্দেশনা, যা প্রায়ই ‘টাইমের তীর’ নামে পরিচিত, তা পদার্থবিদদের কাছে এখনও একটি ধাঁধা হয়ে আছে। তাপগতীয় ব্যাখ্যা, যা এনট্রপির সাথে সম্পর্কিত, এই সমস্যার আংশিক সমাধানই দেয়।
৯. মৃত্যুর পর জীবন
মৃত্যুর পর জীবনের ধারণাটি গভীর রহস্যগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে বিজ্ঞান কিছুটা অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করলেও, চূড়ান্ত উত্তর দিতে পারেনি। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাছাকাছি-মৃত্যু অভিজ্ঞতা এবং শরীরের বাইরে চলে যাওয়া ঘটনাগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে এসব ঘটনা মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, যেমন চরম চাপ বা আঘাতের মুহূর্তে আরইএম (র্যাপিড আই মুভমেন্ট) ঘুমের অনুপ্রবেশ।
তবে, এই ব্যাখ্যাগুলো কোনো পরকাল নিশ্চিত করে না, বরং মৃত্যুর কাছাকাছি অভিজ্ঞতা অর্জনকারী ব্যক্তিদের রিপোর্ট করা ঘটনাগুলোর জন্য একটি শারীরবৃত্তীয় ভিত্তি প্রদান করে। বিতর্কটি এখনও চলমান, কিছু তত্ত্ব প্রস্তাব করে যে, চেতনা শারীরিক শরীর থেকে আলাদাভাবে থাকতে পারে, তবে এই ধারণাগুলো এখনও প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র অনুমানই রয়ে গেছে।
১০. নন-কোডিং ডিএনএ
প্রায়ই “জাঙ্ক ডিএনএ” নামে পরিচিত, নন-কোডিং অংশগুলি মানুষের জিনোমের একটি বড় অংশ গঠন করে। বহু বছর ধরে, এই সিকোয়েন্সগুলোকে কার্যহীন মনে করা হতো। তবে, সাম্প্রতিক গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে এগুলো জিনের নিয়ন্ত্রণ ও প্রকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নন-কোডিং ডিএনএর সঠিক উদ্দেশ্য এবং প্রভাব এখনো জেনেটিসিস্টদের মধ্যে গভীর গবেষণা ও বিতর্কের বিষয়।
১১. ফের্মি প্যারাডক্স
পদার্থবিদ এনরিকো ফের্মির নামে নামকৃত ফের্মি প্যারাডক্স প্রশ্ন তোলে, কেন আমরা মহাবিশ্বের বিশালত্বের পরেও ভিনগ্রহের জীবনের কোনো প্রমাণ পাইনি। লক্ষ লক্ষ তারকা এবং সম্ভাব্যভাবে বাসযোগ্য গ্রহের উপস্থিতিতে অন্য কোথাও জীবনের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। তবুও, অন্যান্য সভ্যতা থেকে যোগাযোগ বা সংকেতের অভাব একটি রহস্যময় নীরবতা তুলে ধরে।
১২. পাইওনিয়ার অ্যানোমালি
১৯৭০-এর দশকের শুরুতে উৎক্ষেপিত পাইওনিয়ার ১০ এবং ১১ মহাকাশযানগুলো শনি গ্রহের কক্ষপথ অতিক্রম করার পর তাদের পূর্বাভাসিত গতিপথ থেকে অজানা কারণে বিচ্যুত হয়। এই অস্বাভাবিকতা একটি অজানা শক্তির প্রভাবের ইঙ্গিত দেয় যা মহাকাশযানের উপর কাজ করছিল। যদিও থার্মাল শক্তি একটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে প্রস্তাবিত হয়েছে, এই বিচ্যুতির সঠিক প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা এখনও চলছে।
Leave a comment