বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল কী?
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল একটি রহস্যময় ত্রিভুজাকৃতির জায়গা বিশেষ। তবে এর অন্য একটি নাম হলো ডেভিল ট্রায়াঙ্গেল। এর এক কোণে বারমুডা দ্বীপ আর অন্য দুই প্রান্তে মায়ামি বিচ ও পুয়ের্তে রিকোর সান জুয়ান।
যত রহস্য শয়তানের ত্রিভুজে !
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পাঁচটি টিভিএম অ্যাভেঞ্জার উড়োজাহাজ এবং একটি উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়। সেই থেকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যের শুরু। এরপরও বেশ কিছু উড়োজাহাজ ও জাহাজ নিখোঁজ হয়েছে এই স্থানে।
অঞ্চলটি নিয়ে এমন একটি থিওরি রয়েছে যে, এখানে একবার প্রবেশ করলে সেখান থেকে বের হবার বা কোনো তথ্য বের করে আনার কোনো অবকাশ নাই। তেমনি কিছু ঘটনা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
- ১৮৭২ সালে মারি সেলেন্ত নামের একটি মালবাহী জাহাজ নিউইয়র্ক বন্দর থেকে রওনা হয়। দীর্ঘদিন যাবৎ জাহাজটি ফিরে না আসায় অনেক খোঁজাখুঁজির পর জাহাজটিকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু অদ্ভুদ ব্যাপার হলো ১১ জন কর্মীর নিখোঁজ হওয়া ছাড়া জাহাজের সব মালপত্র, খাবার সবকিছু একদম অক্ষত ছিল।
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউএসএস সাইক্লোপস নামক একটি জাহজ মার্কিন সরকার ব্রিটিশদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে পাঠায়। কিন্তু বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কাছে যখন জাহাজটি আসে তখন ৩০৬ জন ক্রু নিয়ে কোনো চিহ্ন না রেখেই উধাও হয়ে যায়।
- তবে মেরিন সালফার নামক জাহাজটির নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বিখ্যাত। ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে ১৫ হাজার টন গলিত সালফার আর ৩৯ জন ক্রু নিয়ে রওনা হয় জাহাজটি। কিন্তুু বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে অবস্থান কালে মুহুর্তে জাহাজটির সাথে রেডিও ট্রান্সমিশন বন্ধ হয়ে যায়। এবং বিশাল আকৃতির এই জাহাজ নিমিষেই নিখোঁজ হয়ে যায়।
- বিস্ময়কর রহস্যের ব্যাপার হলো ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের ‘ফ্লাইট নাইনটিন’ নামক পাঁচটি বিমানের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। এ সময় ইউএস নেভীর সেরা ৫ জন অ্যাভেঞ্জার বোম্বার একটি প্রশিক্ষণ মিশনের জন্য রওনা হয়। লেফট্যানেন্ট চার্লস টেলের সাথে পাইলটদের প্রতিনিয়ত কথা হচ্ছিল। কিন্তু যখনি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে বিমানগুলো অবস্থান করছিল তখনি বিমানের সিগন্যাল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিমানগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে বিভিন্ন থিওরি
বিভিন্ন বিমান ও জাহাজ হারিয়ে যাওয়া নিয়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে অসংখ্য থিওরি প্রচলিত আছে। কেউ বলেন, সেখানে সাগরের নিচে বড় দৈত্য আছে। কারো কারো মতে, এলিয়েন এসে জাহাজ বা উড়োজাহাজ উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। তবে, সায়েন্টিফিক্যালি ৫টি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমনঃ
পৃথিবীতে এমন আরও অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে কম্পাসে সঠিক রিডিং পাওয়া যায় না। তেমনি এখানকার ম্যাগনেটিক ফিল্ড। এখানে কম্পাস যথাযথ রিডিং দেয় না।
এ এলাকাটির আশপাশ অগভীর, অসংখ্য হিডেন শো’জ রয়েছে; তাই জাহাজ আটকে যায়।
একটি বিশেষ হ্যারিক্যানপ্রবণ অঞ্চল হলো বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। সবচেয়ে বেশি সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় দেখা যাওয়া অঞ্চলগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের ওই অঞ্চলটি।
সমুদ্রের পানির নিচে মিথেন হাইড্রেটস কিংবা মাড ভলকানোর সৃষ্টি হলে পানির ওপরে থাকা জাহাজ ডুবে যেতে বাধ্য।
এছাড়াও হিউম্যান সাইকোলজির মত একটি বিষয় এখানে কাজ করে। তাহলো বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে মানুষের বেশি আগ্রহের কারণে, অন্য অঞ্চলের দুর্ঘটনাগুলোকে চোখের আড়ালে পড়ে যায়। এ অঞ্চলটা আসলে সমুদ্রের অন্য অঞ্চলের মতোই। এখানে প্রতিনিয়ত অসংখ্য জাহাজ চলাচল করে। এমন না যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল ছাড়া পৃথিবীর অন্য জায়গায় এত বেশি দুর্ঘটনা হয় না। বিজ্ঞানীদের মতে, এই অঞ্চলটা মানুষের মুখে মুখে বেশি পরিচিতি পেয়ে গেছে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর রহস্য গুজব নাকি সত্য?
এই অঞ্চলে জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার যেসব থিওরি আজ পর্যন্ত শোনা গেছে তার মূলত কোনো রহস্য নেই ও ভিত্তিহীন বলে মনে করছেন গবেষকরা। কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটিও মিথ্যা নয়। তা কেবল নিছক দুর্ঘটনা। ওই এলাকা দিয়ে আমেরিকা, ক্যারিবীয় ও ইউরোপের অঞ্চলে প্রচুর জাহাজ চলাচল করে। নিয়মিত অসংখ্য উড়োজাহাজেরও যাতায়াত রয়েছে। মাঝেমধ্যে এ ধরণের এলাকায় এ রকম দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। অন্যান্য অঞ্চলেও এমন অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখন প্রশ্ন হলো বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে এত আলোচনা কেন?
পুতুলনাচের ইতিকথায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে। আসলেই, মানুষ বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধানের চেয়ে ভয় পাওয়াটাকেই বেশি রোমাঞ্চকর মনে করে। তাই ভয়খোর লোকেরা বিশেষ বিশেষ স্থানকে ভয় পাওয়ার জন্য বেছে নেয়। যেমন গ্রামের মানুষ বুড়ো বটগাছ, তেঁতুলগাছ কিংবা বিশেষ কোনো জায়গাকে ভয় পাওয়ার স্থান হিসেবে বেছে নেয়। তেমনি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ওই বুড়ো বটগাছের মতো। বটগাছেও কিছু আপাত ব্যাখ্যাতীত ও কাকতালীয় ঘটনাকে ঘিরে গড়ে ওঠে গুজবের ভিত।
বিজ্ঞান কী বলে?
অমীমাংসিত রহস্যের কোন রহস্যের বিজ্ঞানে ঠাঁই নেই। কোনো তত্ত্ব প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞানে সেটা তত্ত্ব হিসেবে মর্যাদা পায় না। তবে এত লোকের রহস্যের কথার কি তাহলে কোন মূল্য নেই? গুজব রটনাকারীরা যত বেশি গুজব রটিয়েছে বিজ্ঞানীরা তত বেশি গবেষণা করেছেন। বিজ্ঞানীরা দুর্ঘটনার আরেকটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। প্রচুর মিথেন হাইড্রেড গ্যাসের উৎস আছে ট্রায়াঙ্গল এলাকায়। সে সব উৎস থেকে বেরিয়ে লক্ষ-কোটি বুদ্বুদের কারণে পানির ঘনত্ব কমে যায়। আর পানির ঘনত্ব কমে গেলে তা জাহাজের জন্য বড় বিপদ। অতি আধুনিক জাহাজও মুহূতের্র মধ্যে ডুবে যায়। এ কারণেই পানির অতি ঘনত্বের কারণে ডেড-সীতে জাহাজ কেন, সাঁতার না জানা মানুষও অনায়াসে ভেসে থাকতে পারে।
তবে মিডিয়া হিপোক্রেসি হল বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যের সবচেয়ে বড় নিয়ামক। তার পেছনে অন্যতম কারণ হল ব্যবসায়িক চিন্তা। আর্নেস্ট ট্যাভেস ও ব্যারি সিংগার দীর্ঘদিন পাখির চোখ রেখেছেন ওই অঞ্চলের ওপর। সঙ্গে শয়তানের ত্রিভুজ নিয়ে লেখা ট্যাবলয়েডের প্রবন্ধ ও বইপত্রের দিকেও রেখেছেন সতর্ক দৃষ্টি। এক শ্রেণির কলম ব্যবসায়ীরা বারমুডা ত্রিভুজ নিয়ে অত্যন্ত কৌশলে মিথ তৈরি করেছেন। তারপর দুর্ঘটনার সঙ্গে মিথগুলো মিশিয়ে, তাতে রং চড়িয়ে বাণিজ্য করেছেন। এসব কাহিনিতে পাঠক অনেক বেশি রোমাঞ্চিত হয়।
তবে সব লেখকই মিথ নিয়ে বাণিজ্য করেননি, মিথ ব্যবসায়ীদের তথ্য-প্রমাণের অসারতা প্রমাণ করতে কেউ কেউ রীতিমতো গবেষণা করে কলম ধরেছেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন মার্কিন লেখক ল্যারি কুশে। তিনি বারমুডা রহস্যের মিথকে নাকচ করে দিয়ে ১৯৭৫ সালে দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গল মিস্ট্রি: সলভড নামক একটি বই লেখেন।
মিথের প্রচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কুশে বলেছিলেন, সস্তা জনপ্রিয়তা আর টাকার লোভে এসব লেখক অনেক ঘটনার অতিরঞ্জন করেছেন। এমন সব কাল্পনিক দুর্ঘটনা যা কখনো ঘটেনি তার দায় চাপিয়ে দিয়েছেন বারমুডা ত্রিভুজের ওপর। আবার ত্রিভুজের বাইরে ঘটা অনেক ঘটনাকেই ত্রিভুজের নামে চাপিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।
কুশে খেয়াল করে দেখলেন যে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সাগর-মহাসাগরের দুর্ঘটনার খতিয়ান ঘেঁটে দেখা যায়, সারা বিশ্বের গড় দুর্ঘটনার চেয়ে বারমুডা অঞ্চলে গড় দুর্ঘটনার পরিমাণ মোটেও বেশি নয়। আরেকটা বিষয় হলো ওখানে যদি সত্যিই রহস্যময় কিছু থাকে তাহলে নৌযান আর বিমানকে কেন হাপিস করে দেয়, অন্য যানবাহনগুলোকে নয় কেন? মজার ব্যাপার হলো, অনেক ছোট–বড় দ্বীপ আছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল অঞ্চলে। দিব্যি মানুষ আর পশুপাখিরা বাস করছে সেসব দ্বীপে। সে সব অঞ্চলে অভিশাপ নিয়েও মানুষ দিনের পর দিন স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে!শয়তানের রোষ তাদের ওপর কেন পড়ছে না? ওসব এলাকায় স্থলভাগের যেসব গণপরিবহন রয়েছে, সেগুলো কেন হাপিস হচ্ছে না! তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে, আদৌ রহস্যময় কিছু ওখানে নেই।
কুশে যে অভিযোগ ও বিশ্লেষণ করেছেন তা যে ভিত্তিহীন নয় সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় ফ্লাইট নাইন্টিনের ক্ষেত্রে। দুর্ঘটনা নিয়ে যখন তদন্ত হয়েছিল তার রিপোর্টে অনুসারে মূলতঃ পাইলটদের ভুলের কারণেই ক্র্যাশ ল্যান্ডিং হয়েছিল। মৃত স্বজনদের যেন ভিলেন না বানানো হয় সে কারণে পাইলটের পরিবার আপত্তি জানায়। এবং অনুরোধ করে যাতে তাদের মৃত স্বজনদের যেন ভিলেন না বানানো হয়। ফলে তদন্ত কমিশন তাঁদের অনুরোধ রক্ষা করে। রিপোর্ট সংশোধন করে দুর্ঘটনার কারণ ‘অজ্ঞাত’ লিখে দেয়। সে সংশোধিত রিপোর্ট রহস্য হিসেবে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
Leave a comment