অবস্থান
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। দেশের মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলায় এ প্রকল্পের অবস্থান। সেতুর উত্তর প্রান্তে মাওয়া, লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ এবং দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরীয়তপুর, শিবচর ও মাদারীপুর।
শুরুটা কিভাবে হয়েছিল?
১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ সম্পন্ন হয়। ২০০১ সালে জাপান পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয় বাংলাদেশের কাছে, যেখানে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া এলাকাকে সেতু নির্মাণের জন্য নির্বাচন করা হয়। সেই জরিপের ভিত্তিতে, ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এরপর, জোট সরকার মাওয়া পয়েন্টে কাজ স্থগিত করে এবং মানিকগঞ্জের আরিচা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের জন্য পুনরায় জরিপ করার পরামর্শ দেয় জাপানকে। দ্বিতীয়বার জরিপের পর, জাপান আবারও মাওয়া পয়েন্টকে সেতু নির্মাণের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে উল্লেখ করে নতুন প্রতিবেদন জমা দেয়।
২০০৪ সালের জুলাই মাসে, জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ অনুসারে সরকার মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেতুর নকশা প্রণয়নের জন্য একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পুরো নকশা প্রণয়নের জন্য একটি পরামর্শদাতা সংস্থা নিয়োগ দেয় এবং ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর নকশা চূড়ান্ত করা হয়।
২০০৭ সালে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন পায়। প্রথমে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা থাকলেও পরে নকশা পরিবর্তনের কারণে ব্যয় বাড়ে। ২০১১ সালে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধন করে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা করা হয়, আর ২০১৬ সালে তা বাড়িয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা করা হয়। সবশেষে, মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকায়।
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ এনে পরে তারা প্রকল্প থেকে সরে যায়। এরপর এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও ঋণ প্রত্যাহার করে। অবশেষে, বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়, এবং বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর না করে সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়।
পদ্মা সেতুর নকশা এবং নির্মাণ কাজে কারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন?
প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম এর মতে , পদ্মা সেতুর নির্মাণের ক্ষেত্রে একক কোন ব্যক্তির অবদান নেই , অনেক কনসালটেন্ট প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। তার মধ্যে বিশেষজ্ঞরা যাচাই বাছাই করে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই বলা হয়ে থাকে , ব্যাপারটা এককভাবে নয়, যৌথভাবে হয়েছে।
পদ্মা সেতুর নকশার দায়িত্ব ছিল নিউজিল্যান্ড ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এইসিওম। নকশা ও প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। যদিও তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের বয়স ১২০ বছর।
নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানটি পাঁচটি কোম্পানি একসাথে মিলে তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে আরও ৫০টি কোম্পানি তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
হংকংয়ে এই কোম্পানির নেতৃত্বে ২০০৯ সালে পদ্মা সেতুর নকশা তৈরির কাজ শুরু হয়। তাদের সাথে আরও ছিল কানাডার নর্থ ওয়েস্ট হাইড্রোলিক কনসালটেন্টস, অস্ট্রেলিয়ার এসমেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং বাংলাদেশি এসিই কনসালটেন্টস লিমিটেড।
অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া এর মতে, প্রথমে তারা আমাদের পদ্মা সেতুর একটি নকশা দেয় এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সেটি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। বর্তমান সময়ে যেভাবে নকশা হয়, সেখানে ব্যক্তি কারও নাম থাকে না, যে প্রতিষ্ঠান নকশা তৈরি করে, তাদের নামেই পরিচিত হয়।
যেহেতু পদ্মা নদী ছিল খরস্রোতা ফলে এই বিশাল অবকাঠামোর জন্য শুধু নকশা প্রনয়ণ যথেষ্ট ছিল না। তাই নদীর সার্বিক রক্ষার জন্য নদী শাসনের নকশাও তৈরি করতে হয়।
নদী শাসনের নকশাটি যিনি তৈরী করেছিলেন তিনি ছিলেন কানাডিয়ান নাম ব্রুস ওয়ালেস । তাঁর সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির প্রকৌশলীরাও।
১১ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ টিম
বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেতু বিষয়ক যেকোনো কারিগরি সিদ্ধান্ত এই বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত ছিল চূড়ান্ত।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ছিলেন। পরবর্তীতে তার মৃত্যু হলে, অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া এই কমিটির প্রধান হন।
আরও যারা এই কমিটিতে ছিলেন তারা হলেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ , পাইলিং বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হোসাইন মোঃ শাহিন ও নদী বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত। এবং কমিটিতে থাকা মাটি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ এম এম সফিউল্লাহ বিগত বছর মারা যান।
এছাড়াও দুজন জাপানের, একজন করে নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ এই কমিটিতে ছিলেন।
পদ্মা সেতুর নকশা, অবকাঠামো, পাইলিং, সংযোগ সড়ক ইত্যাদি বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং কনসালট্যান্টদের পরামর্শের বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত দিয়েছে এই কমিটি।
আরও ছিল স্টিয়ারিং কমিটি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি। এধরণের কমিটির সদস্য ছিল নয়জন করে, যারা ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয় , সেতু বিভাগ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। তাদের দায়িত্ব ছিল প্রকল্প পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা।
এদের মধ্যে মোঃ শফিকুল ইসলাম ২০১১ সাল থেকে প্রকল্প পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে তিনি সড়ক ও জনপদ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন করা তার মূল কাজ ছিল ।
২০১৩ সালে তার চাকরি থেকে অবসরের সময় হলেও সরকার তাকে সেই পদে বহাল রাখেন। তার হাত ধরেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমাপ্তি হয়েছে।
যেভাবে হয়েছে পদ্মা নদী শাসনের কাজ
পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে নদী ব্যবস্থাপনার কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞ দলের একজন সদস্য ড. আইনুন নিশাত, বলছেন পদ্মার তলদেশে এবং দু’পাশে নরম মাটি ও বালি থাকার কারণে কাজটি ছিল বেশ কঠিন ও জটিল। তাই বিভিন্ন জটিলতার ধাপে ধাপে সেতুর নকশাও পরিবর্তন করতে হয়েছে।
তার মতে, সেতুর ভার বহনের জন্য খুব গভীরে পাইল বসানো অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ ছিল। এত গভীরে যাওয়ার কারন হল উপরের ৬০ থেকে ৭০ মিটার শুধু পানি, যেখানে পাইলের কোন শক্তি নেই।
শেষ পর্যন্ত অনেক গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও ওই গভীরতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তখন পরিবর্তন করতে হয়েছে সেতুর নকশা।
নির্মাণ কাজের তদারক রবার্ট জন এভস
কোরিয়ান কোম্পানি কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন (কেইসি) পদ্মা সেতুর পুরো নির্মাণ কাজ তদারকির কাজ পেয়েছিল এবং তদারকি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের নাগরিক রবার্ট জন এভস। তাদের কাজ ছিল পুরো নির্মাণ কাজটি ঠিক মতো হচ্ছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করা।
চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং সেতু নির্মাণের কাজ পেয়েছিল।
মালয়েশিয়ান একটি কোম্পানির সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলাদেশি কোম্পানি আব্দুল মোনেম লিমিটেড পদ্মা নদীর দুই পাড়ের সংযোগ সড়ক আর সার্ভিস এরিয়া তৈরির দায়িত্ব পেয়েছিল। এ কাজ তদারকির দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
পদ্মা সেতু নির্মাণে জড়িত ছিলেন প্রায় ২০টি দেশের নাগরিক। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, ইতালি, ডেনমার্ক, মালয়েশিয়া, কলম্বিয়া, তাইওয়ান, নেপাল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। তার মধ্যে ১৩৮ ব্যক্তি প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
Leave a comment